রাতের ভূচিত্র

অন্ধকার কাটা পড়ে—
বেপরোয়া ট্রেনের চাকায়,
যেমন দুরন্ত সঙ্গমে টুকরো হয়—
প্রিয় রমণীর সমূহ বাসনা।
আমরা ভালোবেসে ভালোবাসা—
এমনকি অঙ্কের পাঠও শিখিনি, না শিখেছি গাণিতিক হিসাব;
হিসাবে বড্ড কাঁচা বোকা পুরুষেরা
আমরা ধর্ষক হয়ে উঠি তমসিত রাতের অরণ্যে
কদর্য কন্দর আমাদের ঠিকানা;
কী করে বাজবে কৃষ্ণের বাঁশি!
কী করে ঘর হবে নন্দিন আবাস!
কিছু মানুষের ঘুমের শব্দ—
স্টেশনের চা-ওয়ালার নাম
ওপরে ঝোলানো ফ্যানের ব্লেডে—
কেটে টুকরো হয় স্থির অন্ধকারে,
তেমনই অনাদরে রমণীর প্রেম-অশনা ভেঙে খানখান
হয়ে যায় সঙ্গ-আকাঙ্ক্ষা!
পুরুষ,
আমি সেইসব কাচের গুঁড়ো, টুকরো হয়ে যাওয়া–
রতির বাসনা, খানখান আঁধারের কাতর মিনতি
রেখে দেবো বলে জেগে আছি স্টেশনের
অন্ধকার বিছানায়,
গৃহহীন জোনাকির মতো!
একটি নন্দিত মিলনের আকাঙ্ক্ষায়
অমি তাই সফুরার ঠিকানা বদলাই
রাতের ভূচিত্রে।

দামিনী ও মেঘনিশীথ

নকশি-আঁকা একফালি কাগজ—
এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফুটিয়ে তুলব
বিধুর অবসাদ, মৃত্যু আর নিঃসঙ্গ বৃক্ষের পাতাঝরা সময়
ঢেকে দেবো আমার বিষাদতাড়িত দিনযাপনের হিসেব
ঢেকে দেবো প্রথম প্রেমের শব!
‘প্রথম’ বললেই দ্বিতীয়র কথা আসে
প্রকৃতপক্ষে আমার কোনও দ্বিতীয় ছিল না;
বিকেলের লালচে রঙে পিঠ ঠেকিয়ে—
ভাবি, সময় স্রোত ইচ্ছে স্বপ্ন সকলই বয়ে চলে যায়
যেতে যেতে যেতে ফুরিয়ে আসে…
এই যেমন একসময় পূর্ণ চোখেও—
তোকে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি,
এখন আধবোঁজা চোখে সকল বুঝি, সমস্ত দেখি
যেমন দেখি, তুই আর তোর বিরহকে পাশাপাশি রেখে—
কী অনায়াসে প্রেমের ফুলকি ছড়াস!
ইদানীং হঠাৎ হঠাৎই—
মনের গলি ঘুঁজিতে ঢুকে পড়িস তুই,
ঠায় বসে থাকিস গহিনের জলজ পেয়ালায়;
কিছুরই হিসেব থাকে না আমার
কতবার আসিস, কতক্ষণ থাকিস কোনওকিছুরই না!
সময় এগিয়ে চলে
অথচ কী আশ্চর্য, আমার সময় স্থির হয়ে আছে—
সাত বছর তেত্রিশ দিন ছাপ্পান্ন ঘণ্টা;
পাহাড় মিশে যায় নীলে
পাহাড়ের বুক দীর্ণ করে গড়িয়ে নামে ঝরনার জল
জলের মাঝে লুকনো এক কষ্ট-পাথর—
আমার দিকে বিধুর চোখে তাকিয়ে থাকে

আমি না বলতে পারি আমাকে না সেদিনের—
স্নানের শিহরণ,
পাথর ঠিক মনে রাখে জলের উচ্ছ্বাস!
পাথরও বালিকণার মতো—
একদিন খসে পড়ে, জলস্রোতে মিশে যায়;
আমার চারদিকে এখন নৈঃশব্দের নীল আগুন
আকাশে অর্থহীন মেঘ উড়ে চলে
আমি অন্ধকারের বিষন্ন ছায়াতে স্থির
গভীর আঁধারেও স্পষ্ট দেখি—
তোকে জড়িয়ে আছে আমারই মতো একটা ‘কে’!
তুই আপন মনে ভেসে চলেছিস
হাসছিস কাঁদছিস, কী করে পারিস বল তো?
আমার তো হয়ে উঠল না!
দামিনী চেয়ে দেখ,
তোর ছায়া কিন্তু তোর পাশেই
একদিন চেষ্টা করে দেখিস দূরে সরিয়ে দিতে পারিস কি না!
যদি পারিস, তখন না হয় আমি–
প্রেমহীন আঁধারে ডুবতে ডুবতে সাঁতরে খুঁজব ডাঙা…।

আনালিয়া আমার প্রেমিকা

স্থির হয়ে থাকতে থাকতে—
বরফের চোখে ঘুম নেমে আসে,
বরফ মানে ‘আনালিয়া’, আমার প্রেমিকা
পূর্বাভাস বলে তুষার নামবে, আরও শীত
আরও আরও শীত!
জানলার শার্সিতে আনালিয়ার চোখ
কেঁপে ওঠা দেখি, কাচের ওপারে তুষার, কাচের ওপারে ভয়

আনালিয়ার হাত বরফের মতো হিম!
প্রেম হামাগুড়ি দিতে জানে না
স্থির দাঁড়িয়ে থাকে নয়তো মুখ থুবড়ে উপুড় শোয়
একবার উপুড় শুলে মধ্যসাগরে নাবিকের নৌকাডুবি;
প্রেমের শেকড় মৃত্যুবাহক
পতনের শব্দে ঘুমচূর্ণ অনিদ্রা নামে!
একবার অনিদ্রা নেমে এলে—
প্রেমিককে পেরিয়ে যায় প্রেমিকের অতীত,
সে তখন শূন্যগামী সিঁড়ি ধরে অনন্ত বায়!
একদিন আমি আনালিয়ার প্রেমিক ছিলাম।

ঘুমেরও অনিদ্রা থাকে

ঘুমেরও ‘অনিদ্রা’ থাকে—
বুঝে ওঠার আগেই আমার চোখে জেঁকে বসে
স্বপ্নের গভীরে থাকা যে বাড়ি
সমস্তই কাচে ঘেরা, কাচবাড়ি;
আলো জ্বলে না! না জ্বলে মোমের বাতি না ঝাড়লণ্ঠন
তবু কী কাচগলা ঝকঝকে সাদা—
বকপালকের স্নিগ্ধ ওড়ে!
আলোহীন শয্যাদৃশ্যে—
তুমুল সমুদ্রজাগা তরঙ্গ…
তুলো ওড়ে, নরম শুভ্র কার্পাস তুলো
কোমল বালিশ ছিঁড়েখুঁড়ে নেতিয়ে পড়া—
শ্বেতপাথরের বুকের ওপর…
স্বর্গের নিচে—

সেই কাচের চাঁদঘর বরফভ্রমে এখন
শীত নামা হিমঘর;
সেই স্বাতিচোখ, ভোর পর ভাঁটফুল—
চুম্বনের ঘুমন্ত মুখ, তীর্থ দিঘির থই
কাজল চোখের ঠার, পুষ্ট ঠোঁটের কম্পন
কোথাও দেখি না!

একটি কঙ্কালের খোয়াবনামা

আজ সন্ধ্যায়—
আকাশে একটিও তারা নেই,
চাঁদের শরীরে খুব বেশি ক্ষত
ক্ষত আমার হৃৎপিণ্ডের লোহিত নিলয়েও!
যে নৌকা দিগভ্রান্ত
আমি তার মাঝি, বৈঠা নেই
বিপুল এই জলরাশির কোনখানে আমি—
ঠিক জানি না-পাড় খুঁজি!
‘আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে…’
কে ভাসায় কেইবা ডোবায়, আমি তাও জানি না
আমি আসলে কিছুই জানি না
না কুল না শ্যাম, শুধু জানি শ্যামের বাঁশি—
গোপিনী গৃহত্যাগ করেছিল!
নৌকার ক্লান্ত পাটাতনে—
আমি চোখ বুঁজে থাকি, আমার খুব জলের পিপাসা
‘ওয়াটার ওয়াটার এভরিহয়ার, নর আ ড্রপ টু ড্রিংক…’!
এই কোলাজ পিপাসার জল—
অপার জলরাশির কোথাও নেই,
এই জল—

আসমুদ্র হিমাচলও দিতে পারে না,
আমি তাই কূল খুঁজি
খুঁজতে খুঁজতে একদিন কঙ্কাল হয়ে যাই