জীবন না জীবিকা, কোনটি আগে?

জীবন না জীবিকা, কোনটি আগে?

ডা. কে এম আবু জাফর

প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজন বারবার প্রশ্ন করেন, কোনটি আগে? আমি প্রজাতন্ত্র তথা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী হিসেবে নির্দ্বিধায় বলব, একটি অন্যটির পরিপূরক। হ্যাঁ, পরিপূরক। জীবনের জন্যই জীবিকা। কোনওটি কোনওটি ছাড়া চলে না।
তাঁরা প্রশ্ন করেন, এই যে মার্কেট খুলে দেওয়া হলো, এর ইফেক্ট কতদূর গড়াবে?
খুলে না দিয়ে উপায় কী। জীবন ও জীবিকা সমান্তরাল পথেই চলে। পাশাপাশিই দৌঁড়ায়। কারণ জীবিকা না থাকলে জীবন চলে কী করে।
প্রশ্ন করেন, এই যে ভারতে মৃত্যুর স্তূপ, সেটি আমাদেরও ছোঁবে কী?
হ্যাঁ, ছুঁতে তো পারেই। আমাদের এই ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট দেশটির চারপাশেই তো ভারত। সেখান থেকে আমাদের এখানে আসতে তো খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।
প্রশ্ন করেন, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থা কী? আমরা কি সামাল দিতে পারব?
আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা যেরকম থাকার কথা তার চেয়েও যথেষ্ট ভালো অবস্থায় রয়েছে বলেই আমি মনে করি। কারণ বিগত এক বছর এই অতিমারি রোগটি আমরা নিয়ন্ত্রণেই রাখতে পেরেছি। হ্যাঁ, সবখানে হয়তো কেন্দ্রিয় অক্সিজেন সরবরাহ নেই, তবে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। আমরা মৃত্যুকে এখনও পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণেই রেখেছি। একটি উন্নয়নশীল দেশে একেবারে মফস্বল পর্যন্ত পর্যাপ্ত আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, আরটিপিসিআর ল্যাব রাতারাতি স্থাপিত হয়ে যাবে, সেটি আশা করাও কি ঠিক? তবে সরকার ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছেন সর্বোচ্চ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে। আমাদের এখানে আইসিইউ স্থাপিত হয়েছে, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের কাজ চলছে, আরটিপিসিআর ল্যাবের কাজও শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে জীন-এক্সপার্ট মেশিন স্থাপিত হয়েছে। আমরা চাহিদামতো রোগ সনাক্ত করতে পারছি কিন্ত।
ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে স্থল বন্দর বন্ধ হয়েছে। বিমান তো তারও আগে থেকে বন্ধ। সরকার কিন্তু তাঁর কাজটি যথাযথই করছেন। ভ্যাকসিনেশনের কাজ চলছে। এবং পৃথিবীর আরসব দেশের তুলনায় করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার কিন্তু অগ্রগামী।
লক্ষ্য করুন, এই অতিমারি রোগটি কিন্ত পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকেও একেবারে পর্যদুস্ত করে ছাড়ছে। অ্যামেরিকা, ফ্র্যান্স, ইটালি, ব্রাজিল একেবারে পরাস্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত এবং প্রজ্ঞায় আমরা এখনও পর্যন্ত সহনশীল মাত্রার মধ্যেই আছি। কিন্তু কতদিন? যে কোনও অতিমারি মোকাবিলায় তো সকলের সম্মিলিত আন্তরিক উদ্যোগ এবং সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন। আমরা সেটি করছি কি?
বিগত এক বছর যাবৎ জেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্যবিভাগ, পুলিশ প্রশাসন ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে। বোঝাতে চাইছে, এটি থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। জনসমাগম সীমিত করতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিধি মানলেই আমরা আশিভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারি। এটি মানানোর জন্য অবিরত প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা মানছি কি?
আমি মাঠ পরিদর্শনে গিয়ে দেখি, চায়ের দোকানে জটলা। কারও মুখে মাস্ক নেই। দু একজনের যাওবা আছে, সেটি থুতনিতে। হায়, বাঙালি! আমরা কেবল দোষারোপ করতে জানি। নিজেদের কাজটি কিন্তু করি না। এ হামিদ রোডে গেলে দেখি, গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সব। কারও মুখে মাস্ক নেই। কী অদ্ভুত আমরা!
ভারতের ট্রিপল মিউটেন্ট ভাইরাসটি আমাদের দেশে যে আসবে না সেটির কি গ্যারান্টি আছে? কিংবা ইতোমধ্যে হয়তো এসেই গেছে। আসাটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, ভাইরাসটি কিন্তু বায়ুবাহিত। বাতাস তো আর কাঁটাতার দিয়ে আটকানো যায় না। 
যশোরের কথাই ধরুন। ভারত ফেরত দশজন হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে। তারা যে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার মানুষকে সংক্রমিত করেনি, সেটি বলি কী করে। এই হলাম আমরা। আমরা নিজেদের ভালোটা একেবারেই বুঝতে চাই না। কেবল দোষ চাপাই, দোষ চাপানোর চেষ্টা করি সরকারের কাঁধে।
তাহলে উপায়? বাঁচবো কী করে আমরা? উপায় দুটি : স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যেটি সরকার একবছর ধরে বলে আসছেন। আর ভ্যাকসিন।
এই ভ্যাকসিন নিয়ে কত যে রটনা। অথচ এটি অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনেকার অতি নিরাপদ একটি ভ্যাকসিন।
শুনুন, আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী হিসেবে অনুরোধ করি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নইলে কেউই সুরক্ষা দিতে পারবে না আপনাকে। সরকার যথেষ্ট করছেন। করে চলেছেন। আমাদের তো সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে, নাকি? আমাদের সুরক্ষা কিন্তু আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। নইলে ভারতের অবস্থা আমাদেরও দেখতে হবে।
লেখক: ডেপুটি সিভিল সার্জন, পাবনা।

সূত্র: লেখাটি সময় জার্নাল পত্রিকায় প্রকাশিত । লিঙ্ক

আবু জাফর খানের তিনটি কবিতা

আবু জাফর খানের তিনটি কবিতা

মাধবী ও দাহপর্ব

মাধবী…
তুই মুছে গেলে কী আর থাকে বল!
আসলে ইদানীং হু হু ব্যস্ততা আচমকা ঢুকে পড়েছে আমার দেউড়ি ঘরে
তবুও আকাশের ভেতর প্রিয়ঙ্গুমুখ আমি প্রায়ই দেখি
তবুও সবই থেকে যায় কোথাও কোনারক-স্থাপত্য স্মৃতির মতো

মাধবী…
জীবন কি তবে লাট খাওয়া নিঃস্বের নাম?
সদরে খিল দিয়ে সারারাত জেগে থাকে যে যুবক…
সে আর স্থিত হতে পারেনি কোথাও!
শুধু তলিয়ে যায় মাটির ওপর রাখা পায়ের গোড়ালি
আসলে অ-সুখের বাথানে অসুখ সর্বদা স্থায়ী নিবাস পাতে।

মাধবী…
আমার সাধের আমলকি ডালে ঈশ্বরের ঝুলন্ত দেহ!
উঠোনের বাগানটিতে কে যেন রেখে গেছে গুপ্তহত্যার ছুরি
শঙ্খ থেমে গেছে, জাগেনি চক্র-রথ-অশ্বের ক্ষুরধ্বনি;
স্টেশানমাস্টারের মতো যুবকের একা অপেক্ষা
নিশ্চিন্ত-শয়নকাল হেঁটে চলে গেছে বন-ডাহুকীর কাছে
যুবকের ঘুমের ভেতর এখন শুধু রণ-কাতরতা জাগে।

মাধবী…
দাহপর্ব থেকে আর কতদূরে লাল-পলাশের বসন্ত?
এখন পুব থেকে পশ্চিমে পাহাড় পেরোয় যুবকের শ্বাস!

****

দীপাধার

তুমি কেউ নয়!
একটি কোকিল ডেকে গেল…
দ্বিপ্রহরের স্খলিত উত্তাপ সয়ে,
পাখনার ফ্রিলে অভ্রের অভিমান।

তুমি কি কেউ ছিলে?
আমার দিনমান মেঘে মেঘে বেলা যাওয়া…
ছিন্ন শতকের বৃত্তাবদ্ধ জীবনের ঝড়,
নিদ্রাহীন তমসিত প্রেত,
লুপ্ত ধূসর বেদনার সাঁঝ।

তুমি ছিলে না কিছুই!
অথচ মাঝরাতের কুয়াশার মতো…
ঘুমন্ত পৃথিবীতে এঁকে গেলে
জোছনার ফলিত আলো;
দু’হাতে ছিল রজনীর রোদ্দুরে গড়া
জটিল পিলসুজ।

কী বিস্ময় দেখো…
জ্যৈষ্ঠতে এসে ফাল্গুনী পাতারা ঝরে,
কোকিল বলে যায় তুমি কেউ তো ছিলে…
হরিৎ বল্কলে আঁকা জলের আকর।

****

লোডশেডিং

লোডশেডিং-ঘুটঘুটে অন্ধকারে
তোকে আমার আলো মনে হয়েছিল!

রাস্তা নেই!
এই তো একা আমি, তোরা দু’জন…
কোথায় উড়ে গেল ঝড়ো হাওয়ায়
অনেক রাতের গল্প, ভোর ও বছরগুলি!

এখনও আমি নরম মলাটের পেঙ্গুইন
আর উইলিয়াম ব্লেক খুঁজি…
সেইসব সস্তা রেস্তোরাঁ, দু’টো চায়ের কাপ!

এখন আর ভোরের সূর্যকে আকাশ ডাকে না
লোডশেডিং-ঘুটঘুটে অন্ধকার আমার সোহাগপুরে!

Source: Jagonews24 Link